নারী মুক্তিযোদ্ধা সখিনার মনে তাজা সেই স্মৃতি

নিকলীতে সখিনাকে দেখভাল করার কেউ না থাকায় তিনি এখন থাকেন সীমান্তবর্তী বাজিতপুর উপজেলার হিলচিয়ার বড়মাইপাড়া এলাকায়। সেখানে তাঁকে দেখভাল করেন সখিনার ভাগনি ফাইরুন্নেছা আক্তার। সম্প্রতি ওই বাড়িতে গিয়ে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। উঠে আসে মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অংশগ্রহণের গল্প। মুক্তিযুদ্ধে সখিনা বেগমের ভাগনে মতিউর রহমান সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়ে হানাদার পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের হাতে শহীদ হন। ভাগনের অকালমৃত্যু সখিনাকে প্রতিশোধপরায়ণ করে তোলে।

সখিনা, স্থানীয় একাধিক বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বাসিন্দা জানান, মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি গুরুই এলাকায় বসু বাহিনীর নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে রাঁধুনির কাজ করতেন। কাজের ফাঁকে রাজাকারদের গতিবিধির বিভিন্ন খবর সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধাদের জানাতেন। নিকলী উপজেলাকে মুক্ত করার সময়ও সখিনা বেগম খবর সংগ্রহে সক্রিয় ছিলেন। এ ছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহায়তা করেছেন।

সখিনার দাবি, একপর্যায়ে তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। পরে কৌশলে সেখান থেকে পালিয়ে আসেন। আসার সময় সেখান থেকে নিয়ে আসেন এক ধারালো দা। পরে সেই দা দিয়েই নিকলীর পাঁচ রাজাকারকে কুপিয়ে হত্যা করেন। সখিনার ওই দা বর্তমানে ঢাকায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে এবং নামফলকে সখিনা বেগমের নাম উল্লেখ আছে। একাত্তরে সখিনা বেগমের সাহসিকতা ও বীরত্বের কথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নজরে পড়লে ১৯৯৮ সালে তাঁকে ৫০ হাজার টাকা অনুদান দেন। বর্তমানে প্রতি মাসে মুক্তিযোদ্ধার ভাতা পান তিনি।

বয়সের ভারে সখিনা এখন ন্যুব্জ। বিছানা থেকে নিজে নিজে উঠে বসতে পারেন না। বিছানা থেকে উঠে বসান ভাগনি ফাইরুন্নেছা। কথা কিছুটা জড়িয়ে এলেও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতির কথা এখনো ভুলতে পারেননি তিনি। রাজাকারদের হাতে ভাগনের মৃত্যু ও তাঁর ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতনের কথা মনে করে কেঁদে ফেলেন সখিনা। হাত দিয়ে দেখান, কীভাবে সেদিন রাজাকারদের দা দিয়ে কুপিয়েছিলেন।

কিশোরগঞ্জ জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বইয়ের লেখক জাহাঙ্গীর আলম জাহান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর বইয়ে সখিনা বেগমের সাহসিকতার কাহিনি রয়েছে। সখিনার ভাগনে মতিউর রহমানকে যে রাজাকাররা হত্যা করেছিল, তাঁদের মধ্যে একজনকে বসু বাহিনী ধরে নিয়ে সখিনার হাতে তুলে দেয়। সখিনা তাঁকে বঁটি ও দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছেন। তবে পাঁচ রাজাকারকে কুপিয়ে হত্যার বিষয়টি নিশ্চিত না বলে জানান এই বইয়ের লেখক।

সখিনা চোখেও কম দেখেন। জীবনসায়াহ্নে এসে এখন আর তাঁর তেমন চাওয়া-পাওয়া নেই। শুধু অসুস্থতার এ সময়ে কেউ যদি তাঁর একটু খোঁজখবর নেয়, এতেই তিনি খুশি। সখিনা বলেন, ‘ছয় মাস ধরে ভাত খাইতে পারি না। ফলটল খাইয়া কোনো রহমে বেঁচে আছি। বয়সও অনেক হইছে, নড়াচড়া করতে পারি না। সারা দিন বিছানায় পড়ে থাকি।’

সখিনাকে দেখভাল করা ভাগনি ফাইরুন্নেছা জানান, তাঁর খালা এখন বিছানা থেকে উঠতে পারেন না। বিছানায় বসিয়ে রাখলেও ধরে রাখতে হয়। ছয় মাস ধরে ফলফলাদি আর জুস ছাড়া কিছুই খেয়ে হজম করতে পারেন না। প্রস্রাব–পায়খানাও বিছানায় করেন।

ফাইরুন্নেসা বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে খালাকে টানাটানির কারণে আমি নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়েছি। তাঁকে দেখাশোনা করতে অনেক কষ্ট হয়। এর পরও প্রতি মাসে মুক্তিযুদ্ধের ভাতা তুলতে তাঁকে নিয়ে অনেক কষ্ট করে কোলে করে নিকলী সদরে নিয়ে যেতে হয়। তিনি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সরকারি ভাতা যে ২০ হাজার টাকা পান, এর পুরোটাই ওষুধ কিনতে চলে যায়।’

Facebook
Twitter
LinkedIn

আরও পড়ুন